প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯
এস আর অনি চৌধুরী :: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণী রুমানা। ১০১৮ সালের মার্চে তিন মাসের জন্য দেশে বেড়াতে এসে পরিচয় হয় নিজ গ্রামের ছেলে ফখরুলের সাথে। পরিচয় থেকে ধীরে ধীরে ভাললাগা, প্রণয়। ছুটি শেষে ওই তরুণী যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেলেও দুজনের সম্পর্ক অটুট থাকে। দূর পরবাস থেকে কথা হয় মূলত হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভাইভারের মতো অনলাইনভিত্তিক অ্যাপের মাধ্যমে। এবং বেশিরভাগ সময়ই ভিডিও কলে।
ফখরুল আবার রুমানাকে একটু বেশিই ভালবাসে। মনের মানুষকে দিনের পর দিন একই রূপে দেখে তার আর তৃপ্তি মেটে না, রুমানার কাছে অনুরোধ রাখে একটু ‘ভিন্নরকমভাবে’ দেখার সুযোগ দেওয়ার জন্য। রাতবিরেতে এত কাপড়চোপড় পরা থাকলে দেখায় পূর্ণতা আসে কি? অতি সাধারণ এক চাওয়া। ভালবাসা যখন গভীর হয়ে ওঠে অমন এক আধটু দুষ্টুমিষ্টি চাওয়ার অভ্যুদয় ঘটবেই। সরল মনে তিনি প্রেমিকের আবদার মেনে নেন। ফখরুলের চাওয়া অনুযায়ী এর পর থেকে প্রায়শই তিনি নগ্ন হয়ে ভিডিও চ্যাটে আসতেন। প্রিয়জনের জন্য এটুকুই যদি করতে না পারেন, তবে এ আর কিসের ভালবাসা! দুদিন পর থেকেই তো তারা এক ছাদের নিচে থাকা শুরু করবেন, এক আধটু দেখাদেখিতে কি আর এমন আসবে যাবে! প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকা রুমানা বুঝতেও পারেন না কতবড় ভুল তিনি করে ফেললেন।
সব স্বপ্ন- কল্পনার সমাধি ঘটিয়ে একসময় প্রতারক প্রেমিক ফখরুল তার স্বরূপ উন্মোচন করে। এতদিনের সকল নগ্ন চ্যাটিং এর ভিডিও- ছবির রেকর্ডেড কপি রুমানাকে পাঠিয়ে সোজা জানিয়ে দেয়, এখন থেকে প্রতিমাসে তাকে ৫-১০ হাজার করে টাকা পাঠাতে হবে। অন্যথায় এসব ভিডিও- ছবি সে রুমানার সকল নিকটাত্মীয়কে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেয়। এখন কি করবে রুমানা! এমন কিছু সত্যিই যদি ঘটে,আত্মহত্যা করা ছাড়া তার ভিন্ন কোন উপায় থাকবে না। বাধ্য হয়েই তিনি সব কিছু মেনে নেন। মাসের পর মাস ধরে ফখরুলকে দিয়ে চলেন চাহিদাকৃত মাসোহারা।
এভাবে ভিতরে ভিতরে কষ্টে মরে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলেও অনন্যোপায় রুমানা সবকিছু কোনরকম ম্যানেজ করে নিচ্ছিলেন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ পরিবারের পছন্দে তার বিয়েও হয়ে যায়। নিজের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে গভীরভাবে অনুতপ্ত রুমানা বিয়ের পর ফখরুলের সাথে সবধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। একমাস মাসোহারা না পেয়ে, বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফখরুল পৃথিবীর ভয়ংকরতম কাজটিই করে বসে। ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জার মারফত কয়েক শত ভিডিও – ছবি পৌছে যায় রুমানার নবপরিণীত স্বামী, ভাশুর , ননদ, বোনের কাছে।
লোকলজ্জার ভয়ে ফখরুলের সকল অন্যায় আবদার মেনে চলেছেন দিনের পর দিন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত সেটা আর তো আড়ালে রাখা গেল না। সম্পর্ক থাকার দিনগুলোতে ফখরুলকে তার উপহার দেওয়া লক্ষাধিক টাকা দামের মোবাইল ফোন দিয়েই এসব ভিডিও রেকর্ড এবং ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি হয়েছে। মানুষ খারাপ হতে পারে। কিন্তু তাই বলে এত বেশি!!! সর্বহারা রুমানার হৃদয় থেকে মানুষের প্রতি বিশ্বাসের শেষ বিন্দুটিও হয়ত মুছে যায়। এখন কি করবে রুমানা! যারা ভাবছেন ‘ আত্মহনন’, তাদেরকে ভুল প্রমান করে দিয়ে এবার ভিন্ন রূপে আবির্ভূত হলেন তিনি। এই রুমানা লোকলজ্জার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অন্যায় সহ্যকারিণী নন, এবার তিনি প্রতিবাদী, অন্যায়কারীর বিচারপ্রার্থী।
থানায় জিডি করার পর গত ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এ বিষয়ে র্যাব কার্যালয়ে অভিযোগ জমা দেওয়া হয়। অভিযোগের ডকেট আমার টেবিলে আসলে আমি রুমানার ভাইকে অফিসে ডেকে কথা বলি। শ্রান্ত, বিধ্বস্ত অবয়ব ভদ্রলোকের। নিজের বোনের অশ্লীল ভিডিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাকে দেখাতে হচ্ছে! এই পরিস্থিতি কেমন করে সহ্য করবেন তিনি! কথা হয় রুমানার সাথেও।
” স্যার, সে আমার জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে, আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই,স্যার”।
কান্নার তোড়ে কথা আটকে যাচ্ছিল বারবার। আহা! ভালবাসার কি নির্মম প্রায়শ্চিত্তই না হচ্ছে মেয়েটির। কখনো কখনো ব্যক্তিক অনুভূতির কাছে পেশাদারিত্বের পরাজয় ঘটে যায়। সিদ্ধান্ত নিলাম, যে কোন মূল্যে হোক, এর জন্য কিছু একটা করতেই হবে। টিম সদস্য কর্পোরাল ইউনুসকে এ সম্পর্কে বিশেষ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই।
থানায় জিডি এবং র্যাব অফিসে অভিযোগ দায়েরের খবর লোকমুখ মারফত চলে যায় অভিযুক্ত ফখরুলের কাছেও। ধূর্ত ফখরুল বিপদ আঁচ করতে পেরে অতি সাবধানী চলাফেরা শুরু করে। নিজ বাসার বদলে অন্য আত্মীয়দের বাসায় রাত্রিযাপন করে, অপরিচিত কারো সামনে পারতপক্ষে যায়ই না। এদিকে আমিও হাল ছাড়ব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়ার পাশাপাশি চলতে থাকে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডও। তার এলাকার মানুষদের মধ্য থেকে সোর্স নিয়োগ করি। ফেরিওয়ালার ছদ্মবেশে একদিন তার গ্রাম থেকে ঘুরে আসি আমি নিজেও।
অবশেষে আজ দুপুরে থানায় মামলা দায়েরের খবর পেয়ে ত্বরিত অভিযান চালিয়ে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলাধীন আরিস খার টিলা গ্রামের চায়ের দোকানের সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করি। এ প্রসঙ্গে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই, সার্বক্ষণিক তদারকির মাধ্যমে আমার এই কাজটিতে মূল ভূমিকা পালনকারী র্যাব ৯ এর সম্মানিত সিও উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান স্যারের প্রতি।
আশা করছি সাহসিনী (হ্যা, এই নাম তাকে আমি দিলাম। এত কাল ধরে মেয়েরা সবাই তো ‘সুহাসিনী’ই হতে চেয়েছে। এখন সময় বোধ করি সুহাসিনী নয়, সাহসিনী হবার) এবার ন্যায়বিচার লাভ করতে সক্ষম হবেন। পাশাপাশি অন্য যারা এভাবে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে দিনের পর দিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন, তাদের প্রতিও এই লোক লজ্জার ট্যাবু ভেঙ্গে ফেলার অনুরোধ রইল। যদি মনে করেন, আপনার নিকটাত্মীয়দেরকে এটা জানানো সম্ভব নয়, তাহলে নিজেই সাহস করে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন পদস্থ কর্মকর্তাকে জানান। পরিস্থিতিতে যেহেতু পড়ে গেছেন, এখন আপনাকে সাহসী হতেই হবে।
আর যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আপনার কিশোরী কন্যা- অনুজাকে অবশ্যই অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইন কন্টেন্টসমূহ ব্যবহার করতে দেওয়ার আগে সেখানে ‘কি করা যাবে’ এবং ‘ কি করা যাবে না’ এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারনা দিয়ে দিতে ভুল করবেন না। কে জানে, কোন বিপদ সেখানে তাদের জন্য ওঁৎ পেতে আছে! আবেগের এই বয়সে ভুল করার সম্ভাবনা তাদেরই সবচেয়ে বেশি।
( রুমানা ওই তরুণীর প্রকৃত নাম নয়, তাকে আড়াল করার জন্য আমি এই ছদ্মনামটি বেছে নিয়েছি। এড়িয়ে গেছি জেলা – উপজেলা- গ্রামের নামও। এছাড়া অন্য সবকিছু আসল। আর হ্যা, ছবিতে আমার সাথে যাকে দেখা যাচ্ছে,এ-ই হলো সেই ফখরুল।)
…………………………………………….
লেখক
শামীম আনোয়ার
এএসপি, র্যাব-৯