প্রকাশিত: জুলাই ২, ২০১৭
ডেস্ক সংবাদঃ অস্তিত্বহীন মসজিদ,মন্দিরের ভুয়া কমিটি, নামসর্বস্ব সামাজিক ক্লাব ও সংগঠন ।এমন সব প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সরকারী বরাদ্দ হাতিয়ে নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা। এমন অভিযোগ ওই এলাকার উন্নয়ন বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের। এখন সময় যত ক্ষেপন হচ্ছে বিষয়টি ততই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চাউর হচ্ছে। আর ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন উন্নয়ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্থ স্থানীয় বাসিন্ধারা। প্রভাব খাটিয়ে চলচাতুরির মাধ্যমে ন্যায্য বরাদ্ধ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অবগত হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা তা লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে।এ নিয়ে পুরো উপজেলায় চলছে তোলপাড়। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ চৌধুরী তুতি এবং ওই ইউনিয়ের একজন ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
জানা যায় ২৯ জুন বৃহস্পতিবার কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর বরাদ্ধের টাকা আত্মসাতের এমন অভিযোগ করেছেন বরমচাল চা বাগানের চা শ্রমিক এবং বরমচাল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।এছাড়াও মৌখিক অভিযোগ করেছেন মহলাল সমাজ কল্যাণ পরিষদের সভাপতি-সম্পাদকসহ অনেকেই। লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা যায়,২০১৬-২০১৭ সালের অর্থবছরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির ২য় পর্যায়ে কুলাউড়া উপজেলার ১৩ টি ইউনিয়নে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মোট ৬৭ লক্ষ ৬৫ হাজার ৪ শত ৫৮ টাকা (৬৭,৬৫,৪৫৮ টাকা) বরাদ্ধ হয়। এর মধ্যে উপজেলার বরমচাল ইউনিয়নে ৮ টি প্রকল্পে মোট ৫ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা (৫,৪৭,০০০ টাকা) বরাদ্ধ আসে। বরাদ্ধকৃত প্রকল্পের মধ্যে কোনাগাঁও জামে মসজিদ উন্নয়ন প্রকল্পে ৩০ হাজার টাকা বরাদ্ধ হয়েছে। যদিও ওই নামে কোন মসজিদের অস্তিত্ব বরমচাল ইউনিয়নে নেই। এছাড়া কালামিয়া বাজার জামে মসজিদে সোলার প্যানেল স্থাপনের জন্য বরাদ্ধ হয়েছে। এই নামেও কোন মসজিদ খোঁজে পাওয়া যায়নি। বরমচালের কালামিয়ার বাজারে একমাত্র মসজিদ হচ্ছে ‘বায়তুল জান্নাত জামে মসজিদ’। ওই মসজিদ কমিটির মোতাওয়াল্লী সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ইছহাক চৌধুরী ইমরানের সাথে যোগাযোগ করা হলে সোলার প্যানেলের জন্য বরাদ্ধ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেননা বলে জানান। এছাড়া বরমচাল চা বাগানের ‘শ্রী শ্রী কৃষ্ণ মন্দির উন্নয়ন’ প্রকল্পে বরাদ্দ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা। ওই মন্দিরের সভাপতি সম্ভু বাউরী ও সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাত্র এবং সাবেক বাগান পঞ্চায়েত স্থানীয় মুরুব্বী গৌরা কুর্মি, অতুল কর্মকার মন্দির উন্নয়ন বরাদ্ধের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান। তারা বলেন স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য অনন্ত লালের সহযোগীতায় ওই মন্দির কমিটির অধিনে এর আগে ২ বার সরকারী বরাদ্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন তারা কিছুই পাচ্ছেন না। এদিকে সোলার প্যানেল স্থাপনে বরাদ্ধকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বরমচাল চা বাগানের ৫ জনের ৪ জনই জানে না তাদের নামে বরাদ্ধ হয়েছে। সুনু মির্ধা, খোকন বাড়াইক, মনোহর কুর্মি, ভুলা কুর্মি জানান, সপ্তাহ দিন আগে সোলার প্যানেল পাব বলে স্থানীয় ইউপি সদস্য চন্দন কুর্মি তাদের ভোটার আইডির ফটোকপি নিয়েছেন। এরপর আর কোন খবর নেই। এদিকে প্রায় মাস দিন আগে অন্য একটি সরকারী বরাদ্দে বরমচাল চা বাগানে ১৫ টি সোলার প্যানেল স্থাপনে বরাদ্ধকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকের ঘরে বিদ্যুৎ থাকা সত্ত্বেও সোলার স্থাপন, আবার অনেকের (দিনমজুর) কাছ থেকে উৎকোচ (কারো কাছ থেকে ১০০০ আবার কারো কাছ থেকে ২৫০০ টাকা) গ্রহণ করে সোলার প্যানেল স্থাপন করে দেন স্থানীয় ইউপি সদস্য চন্দন কুর্মি। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারী বরাদ্ধকৃত প্রকল্পে ঘুষের বিনিময়ে শ্রমিকদের বরাদ্ধ দেয়া হয় বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। বরমচালের ৮ টি প্রকল্পের মধ্যে ‘মহলাল সমাজ কল্যাণ ক্লাব’ নামক সংগঠনের সভাপতি- সম্পাদক এক আর বরাদ্ধে সভাপতি-সম্পাদক দেখানো হয়েছে অন্যদের। ভুয়া সভাপতি -সাধারণ সম্পাদক দেখিয়ে বরাদ্ধ তুলে আনায় এনিয়ে ওই এলাকায় ব্যপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ওই ক্লাবের সাথে সংশ্লিষ্টরা বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। ওই ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসান মাফি এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ তাহলিল জানান, আমরা গরীব-অসহায় মানুষের মাঝে ঈদের পোশাক ও খাদ্য সামগ্রী বিতরণের উদেশ্যে বরাদ্ধ চেয়েছিলাম। কিন্তু উপজেলা পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমাদের না জানিয়ে কে বা কারা টাকা উত্তোলন করেছে। এছাড়াও নামসর্বস্ব শ্রমিক কল্যাণ ক্লাবের বাস্তব অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া যায়নি। বরমচালের শ্রমিকদের একমাত্র সংগঠন বরমচাল পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজিঃ ২৩৫৯)। ওই সংগঠনের নির্বাচিত সভাপতি আব্দুছ ছালাম ও সাধারণ সম্পাদক বাবেল আহমদ ওই বরাদ্ধের টাকা শ্রমিকদের দাবি করে তিনি জানান, উপজেলা পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি কে বা কারা শ্রমিকদের নাম বিক্রি করে টাকা উত্তোলন করেছে। আমরা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। শ্রমিকদের ন্যায্য বরাদ্ধ যদি সটিকভাবে না পাই তবে আমরা আন্দোলনে নামবো। এবিষয়ে উপজেলা আওয়ামীলীগের একাধিক নেতার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন শুধু বরমচাল নয় বর্তমান এমপি তার নিজস্ব লোকজন দিয়ে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে এরকম ভূয়া সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে প্রকল্পের বরাদ্ধকৃত পুরো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। তারা বলেন তিনি স্বতন্ত্র এমপি। দলের নাম ভাঙ্গিয়ে তার সাথে গুটিকয়েক নেতাকর্মী মিলে সরকারের দেওয়া নানা উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্ধকৃত টাকা আত্মসাত করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন। তাদের এমন কুকর্মের দ্বায়ভার দলের উপর বর্তাবে কেন। ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কমিটি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রগুলো ঠিক আছে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলার পিআইও কর্মকর্তা আব্দুল খালেক জানান,এগুলো তুতি (আব্দুর রউফ চৌধুরী তুতি) ভাইরা দিছেন,আমরা তো এবিষয়ে বলতে পারিনা। তবে এবিষয়ে তিনি আর কোন কথা বলতে অপারগতা জানান। সোলার প্যানেল স্থাপনে উৎকোচ নেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য চন্দন কুর্মি জানান, আমি টাকা উত্তোলন করি নি। তাছাড়া বাগানের মুরুব্বি দেবনারায়ণ কুর্মি ও তুতি (আব্দুর রউফ চৌধুরী) চাচারা এসে আমারে বলেন যে তোমার এলাকায় এতোটা সোলার আইসে সঠিকভাবে এগুলো লাগানোর ব্যাবস্থা কর। আমি এগুলো ধরিও না, দেখিও না। কোম্পানীর লোকজন এসে লাগিয়ে দিয়ে যায়। আনিত অভিযোগের ব্যাপারে বরমচাল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ চৌধুরী তুতির কাছে জানতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিয়েও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এবিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোহাম্মদ গোলাম রাব্বির সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এবিষয়ে দুটি লিখিত অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের বিরুধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অস্তিত্বহীন মসজিদ, মন্দির, ক্লাব উন্নয়নে বরাদ্দ সম্পর্কে জানতে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল মতিনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি ঢাকায় (সংসদ অধিবেশনে) থাকায় এবিষয়ে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।