প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৫
মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলার ৬১টি খাসিয়া পুঞ্জিতে বসবাসরত প্রায় ২৫ হাজার খাসিয়া নাগরিক সুবিধার নানা সংকটে দিন কাটাচ্ছেন। ভূমি সমস্যার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে তারা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।
স্মরণাতীতকাল থেকে খাসিয়া জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বসবাস করে আসছেন। পাহাড় ও টিলাভূমিতে পান ও সুপারির চাষই তাদের প্রধান জীবিকা। সিলেট বিভাগে মোট ৭৩টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে—এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৬১টি, সিলেটে ৭টি এবং হবিগঞ্জে ২টি।
‘খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল’-এর তথ্যমতে, খাসিয়া জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০টি নৃ-জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে, যার মধ্যে খাসিয়ারা দীর্ঘদিন ধরে ভূমি সমস্যায় ভুগছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের অধিকাংশ পুঞ্জিতে বন বিভাগের বিধিনিষেধের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছায়নি। প্রায় ৪০টি পুঞ্জিতে এখনো বিদ্যুতের লাইন স্থাপন করা হয়নি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভাবে শিশুদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত। বর্তমানে মাত্র দুটি সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে, তবে স্থানীয় উদ্যোগে প্রায় ৪০টি বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে।
স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগব্যবস্থার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের অনুপস্থিতি এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব তাদের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৩০ থেকে ১০০টি পরিবার বসবাস করে, যাদের অধিকাংশই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
স্বাস্থ্যসেবা ও যোগাযোগব্যবস্থার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রের অনুপস্থিতি এবং বিশুদ্ধ পানির অভাব তাদের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিটি পুঞ্জিতে গড়ে ৩০ থেকে ১০০টি পরিবার বসবাস করে, যাদের অধিকাংশই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
সম্প্রতি কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার কয়েকটি পুঞ্জিতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব পুঞ্জিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেই। অনেকে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে অনেক নলকূপে পানি ওঠে না। দূর থেকে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়। তীব্র গরমে বিদ্যালয় গুলোয় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্টে ক্লাস করতে হয়। কয়েকটি পুঞ্জি ছাড়া বেশির ভাগ পুঞ্জিতে যোগাযোগের ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। কোথাও কোথাও ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ি থাকলেও অধিকাংশ পুঞ্জিতে এই ব্যবস্থা দেখা যায়নি।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মান্রী (সমাজ প্রধান) ফিলা পতমী জানান, খাসিয়ারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষ করে তাদের অধিকাংশ পুঞ্জিতে বিদ্যুৎ ছাড়া বসবাস করতে হচ্ছে। শিশুদের পড়ালেখা হচ্ছে না। মাত্র দুটি সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। পাহাড়ের দূর্গম এলাকার উঁচু জায়গায় বসবাস, অথচ টিলার ওপরে ওঠার রাস্তা নেই অনেক পুঞ্জিতে।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মান্রী (সমাজ প্রধান) জিডিশন প্রধান সুছিয়াং বলেন, বেশির ভাগ পুঞ্জিতে বিদ্যুৎ নেই। অথচ শতভাগ বিদ্যুতায়ন জেলা ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা ভূমির অধিকার এখনো পাইনি। আমাদের খাসিয়া পুঞ্জিতে নিজস্ব অর্থায়নে বিদ্যালয়গুলো পরিচালনা করতে হচ্ছে। সরকারিভাবে বিদ্যালয় গুলোতে একটি ভবনও করা হয়নি। আমরা বিদ্যুতের কথা বললে, বিদ্যুৎ বিভাগ বলে, বন বিভাগের পক্ষ থেকে আপত্তি আছে। এ ছাড়া চিকিৎসা ও যাতায়াতব্যবস্থা একেবারে নাজুক।
মৌলভীবাজার বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. নাজমুল আলম বলেন, খাসিয়া পুঞ্জিতে বন বিভাগ থেকে বিদ্যুৎ বা রাস্তার জন্য অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। সরকার যদি অনুমতি দেয়, তাহলে আমাদের বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
মৌলভীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক এ বি এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘খাসিয়া পুঞ্জিতে বিদ্যুতের সংযোগ দিতে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই। পুঞ্জিগুলো বনের ভেতর হওয়ায় বন বিভাগের আপত্তির কারণে বিদ্যুৎ-সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, খাসিয়া পুঞ্জিগুলো পাহাড়ের ওপরে। এসব পুঞ্জিতে ওঠার সিঁড়িসহ অন্যান্য কাজের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ-ছয়টি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য গত বছর ২-৩ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বছরও কয়েকটি বিদ্যালয়কে সহযোগিতা করা হবে।