২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, শনিবার

জাতীয় সংগীতের ফেরিওয়ালা কুলাউড়ার সুদর্শন রবিদাস।

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯

ফেইসবুক শেয়ার করুন

ডেস্ক রিপোর্ট: সাতসকালে তো বটেই আবার দুপুরবেলায়ও তাঁকে ছুটতে দেখা যায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তিনি জাতীয় সংগীত গাইতে শেখান। শেখান দেশাত্মবোধক আর ছড়া গানও। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তাঁর এই অবিরাম ছুটে চলা। সুদর্শন রবিদাস একজন চারণ সংগীতশিল্পী। শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত শেখানোই তাঁর নেশা। ছড়া, কবিতা, গল্প, দেশাত্মবোধক গান, কৌতুক, শরীরচর্চা আর অন্য গানের পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদের শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার তালিম দিয়ে যাচ্ছেন। অ্যাসেম্বলি শুরু হলেই তিনি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা বা কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের মাঝখানে গিয়ে সঠিক স্বরলিপি, সুর আর কথায় গেয়ে চলেন—আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

একজন সুদর্শন রবিদাস

সুদর্শন রবিদাস চা শ্রমিক পরিবারের সন্তান। তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩ জুলাই। কুলাউড়া উপজেলার লংলা চা বাগানের কুকি টিলা বড় লাইনের বাসিন্দা মৃত দেওনারায়ণ রবিদাসের ছেলে তিনি। জন্মের ছয় মাসের মাথায় তাঁর মা মারা গেলে নানা বলরাম রবিদাস একই উপজেলার রাঙ্গীছড়া চা বাগানের বড় লাইনে নানি দুখনতিয়া রবিদাসের কাছে নিয়ে যান তাঁকে। সেখানেই তিনি লালিত-পালিত হন। তাঁর চারজন ছেলেসন্তান রয়েছে। চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর স্ত্রী সুগিয়া রবিদাস মারা গেছেন।

সুদর্শনের এগিয়ে যাওয়া

সংগীতের প্রতি সুদর্শন রবিদাসের আকর্ষণ শিশুকাল থেকেই। বয়স ৬০ হলেও এখনো সারা দিন স্কুল থেকে স্কুলে ঘুরে বেড়ান। সুদর্শন রবিদাসের ইচ্ছা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত গাওয়ার তালিম দেওয়ার। তিনি আমৃত্যু এ সাধনায় নিজেকে যুক্ত রাখতে চান। সুদর্শন রবিদাস এর মধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গান শেখানোর মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কখনো হেঁটে চলেন, কখনো চড়েন বাসে। পাঁচ বছর ধরেই তাঁর এই রুটিন। এ পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলাসহ দেশের ৭৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ খরচে গিয়ে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত শিখিয়েছেন।

যাঁদের অনুপ্রেরণায় পথচলা

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসায় দিন দিন তাঁর শুদ্ধ সুরে সংগীত শেখানোর কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানরা এ কাজে তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তাঁর জাতীয় সংগীতের তালিম পেয়ে খুশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ আরো অনেকেই। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে দু-তিন দিন করে যান সুদর্শন।

সুদর্শন প্রতি সপ্তাহে দুই দিন করে বাসায় বাসায় গিয়ে জাতীয় সংগীতসহ বিভিন্ন গান শেখান। এসব থেকে যে সামান্য টাকা সম্মানী হিসেবে পান, তা দিয়েই তাঁর সংসার চলে। আলাদাভাবে কোনো উপার্জন নেই তাঁর।

যেভাবে সংগীতচর্চা শুরু করেন

সুদর্শন রবিদাস আট বছর বয়স থেকে কাকা রাম নারায়ণ রবিদাসের কাছে সংগীতচর্চা শুরু করেন। এ ছাড়া তিনি ওস্তাদ রসরাজ মলিক ও বিহারী রবিদাসসহ আরো কয়েকজনের কাছে সংগীতের তালিম নিয়েছেন। ১৯৯২ সালে সিলেট বেতারের শতদল অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন। তিনি ১৯৯৪ সালে কুলাউড়ার রুদ্রবীণা গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হন এবং সেখানেই প্রথম শিক্ষকতা শুরু করেন।

তিনি বললেন

যত দিন বেঁচে থাকব, তত দিন আমি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শিক্ষা দিয়ে যাব। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তিনি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শুদ্ধ জাতীয় সংগীত শিক্ষা দেবেন। অনেক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলির সময় দেখেছি শিক্ষার্থীরা ভুলে ভরা জাতীয় সংগীত গাইছে। তাল, লয়, কথা সব কিছুতেই ভুল। আমার খুব কষ্ট লাগত। সেই কষ্টবোধ থেকেই ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে সংগীত শেখানোর মিশন শুরু করি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতীয় পতাকা ও সংগীত আমাদের গর্বের ধন। এর ভুল গায়নশৈলী আমাকে আহত করে। দেশমাতৃকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই জাতীয় সংগীত শুদ্ধভাবে শিখিয়ে যাচ্ছি।

সুদর্শনের প্রশংসায় শিক্ষার্থীরা

কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অনার্স শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা শাম্মি, কুলাউড়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া জাহান ও মোহন আহমদ, নবীন চন্দ্র সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিহান মুস্তাকিম বলেন, ‘সুদর্শন কাকুর কাছ থেকে আমরা শুদ্ধ সুরে জাতীয় সংগীত গাইতে শিখেছি। তাঁর কারণেই আমরা আজ অনেকে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি ছড়া, কবিতা, গল্প বলা শিখতে পেরেছি। আমরা তাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’

তাঁর স্বপ্ন পূরণ হবে?

সারা দেশে জাতীয় সংগীত শেখানোর ইচ্ছা তাঁর। সামর্থ্য নেই বলে পারছেন না। বয়স কোনো বাধা কি না জানতে চাইলে বললেন, ‘আত্মবিশ্বাস আছে আমি পারব, সহযোগিতা পেলে সারা দেশ চষে বেড়াব।’

উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওর আশ্বাস

কুলাউড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম সফি আহমদ সলমান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘সুদর্শন রবিদাস নিজের আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা থেকে এই মহত্ কাজটি করে যাচ্ছেন। এমন মানুষ সমাজের চালিকাশক্তি। জাতীয় সংগীত বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে শুদ্ধভাবে পরিবেশনের যে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন, তার জন্য আমরা সবাই অনুপ্রাণিত। উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে তাঁর অগ্রযাত্রায় আমাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত থাকবে।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আবেদন জানালেন জাতীয় সংগীতের ফেরিওয়ালাখ্যাত সুদর্শন রবিদাস। বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভালো নেই রবিদাস। তাঁর বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে অবশ্যই তাঁর আবেদন গ্রহণ করে দেখা করার সুযোগ দেবেন এবং সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেবেন।

798 বার নিউজটি শেয়ার হয়েছে
  • ফেইসবুক শেয়ার করুন